রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০০ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকান্ডের জেরে উদ্ভুদ পরিস্থিতিতে পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র কক্সবাজারে এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বিভিন্ন পেশাজীবী সহ সাধারণ মানুষ। এতে আতংকিত সম্প্রতি ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ এখানে চাকুরিরত মানুষ।
সম্প্রতি কক্সবাজারে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, হামলা-সংঘাত, অবরোধ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা, ছিনতাই, মাদকের আগ্রাসণের কারণে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে এই নিরাপত্তাহীনতা ও আতংকের কথা প্রকাশ করেছেন এসব মানুষ। আইনÑশৃংখলার চরম অবনতির এই পরিস্থিতিতে তারা এ জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেদের অভিমতও প্রকাশ করেছেন।
কক্সবাজারের চরম অবনতিশীল এই পরিস্থিতি আমলে নিয়েছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি। সোমবার ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রতিষ্ঠা বাষির্কীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিকে উদ্দ্যেশ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ কোনভাবে হত্যা, রক্তের হুলি খেলা দেখতে চাই না। যে কোন মূল্যে এসব বন্ধ করুন, কঠোর হন। আপনাদের (পুলিশ) কঠোর হতে কেউ মানা করেনি। কক্সবাজার পর্যটন কেন্দ্র, এখানকার পরিবেশ সহিংসতা ও ভয়ভীতি মুক্ত রাখতে হবে। ”
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কক্সবাজার ত্যাগের পরপরই দুইটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ কোনার পাড়ায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে এক বৃদ্ধ। এছাড়া অপর ঘটনাটি ঘটেছে কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে ইউপি নির্বাচনের সদস্য পদের এক প্রার্থী অজ্ঞাত দূর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ১৭ আগস্ট দুপুরে চকরিয়া উপজেলার বড় ভেওলা-মানিকচর (বিএমচর) ইউনিয়নের সিকদার পাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সম্ভাব্য ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী নাছির উদ্দিন সিকদার নোবেলকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত ১৮ অক্টোবর রাতে মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার ফকিরজোম এলাকায় যুবলীগ নেতা রুহুল কাদেরকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৭ অক্টোবর রাতে কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোনের সুগন্ধা পয়েন্টে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোনাফ সিকদারকে গুলি করে অজ্ঞাত দূর্বৃত্তরা। এরপর গত শুক্রবার (৫ নভেম্বর) রাত ৮টার দিকে মহেশখালীর কালারমারছড়ার বাজার এলাকার আত্মসমর্পণকারি জলদূস্য স্বাভাবিক জীবনে ফেরা আলাউদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই দিন রাত সাড়ে ১০ টার দিকে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা কক্সবাজার শহরের লিংকরোড এলাকার ঝিলংজা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কুদরত উল্লাহ সিকদারের অফিসে ঢুকে বেপরোয়া গুলি চালায়। এতে তিনি ও তার বড় ভাই জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম সিকদার গুলিবিদ্ধ হন। দুইদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় শ্রমিক লীগ সভাপতি জহিরুল ইসলাম রোববার (৭ নভেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। এছাড়া গত ৭ নভেম্বর রাতে রামু উপজেলার ঈদগড়ে পূর্ব-শত্রুতার জের ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় রিফাতুল ইসলাম নামের এক য্বুককে ছুরিকাঘাত করা হয়।
এসব ঘটনার মধ্যে ৩১ অক্টোবর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোনাফকে হত্যার চেষ্টা মামলা কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে কক্সবাজার সদর থানায় মামলার দায়ের করেন আহতের ভাই শাহজাহান সিকদার। ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে মেয়র সমর্থিতরা। সড়ক অবরোধ করে কার্যত ৪ ঘন্টা অচল করে দেয়া হয় কক্সবাজার। যেখানে পর্যটক সহ সাধারণ মানুষ ভোগান্তি ছিল। যদিও পরে মেয়রের আহবানে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। তবে পরদিন দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজার পৌর পরিষদের ডাকা ধর্মঘটের কারণে নাগরিক সেবা বন্ধ ছিলো। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ৫ নভেম্বর রাতের হামলায় গুলিবিদ্ধ শ্রমিক লীগ সভাপতি জহিরুল ইসলাম চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইদিন পর মৃত্যু হয়েছে। আর এই মৃত্যুর সংবাদ শুনে শহরের প্রবেশমুখ লিংক রোড় এলাকায় অবরোধ করে শ্রমিকরা। টানা ৩ ঘন্টা অবরোধের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে মানুষকে।
এছাড়া সম্প্রতি রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা, মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ৬ খুন, অপহরণ, অস্ত্র উদ্ধারের অস্থিরতার পাশাপাশি জেলা জুড়ে ছিনতাই ও মাদকের আগ্রাসন বেড়ে গেছে। এর জের ধরে শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরাপত্তা নিয়ে কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহলে প্রশ্ন তৈরী এবং আতংক বিরাজের কথা।
এ প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও গণমাধ্যমকর্মী মহসিন শেখ লিখেছেন, “একটি হত্যা মামলা হবে জহির ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায়। এরপর খুনিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে বলবেন মিথ্যা, ষড়যন্ত্র মামলায় জামিন পেয়েছেন অমুক ভাই, তমুক ভাই। অথবা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের পর খুনিদের ফাঁসি হতেও পারে। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি’র দুর্গ হিসেবে পরিচিত লিংক ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তথা আওয়ামী লীগের চাষাবাদকারী, সদা হাস্যজ্জল জহির ভাইকে আমরা আর কখনও ফিরে পাবোনা। এ দায় কার? এটা কি সুপরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ নিধন নয়? খুনিদের গডফাদার কারা? আজ জহির ভাই, কাল তার মতো আরো মায়ের বুক খালি হবে না তার গ্যারান্টি কি? সকল অপরাধের ঘটনায় জড়িত এসব ইন্দনদাতাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা ছাড়া অপরাধ কর্মকাণ্ড দমন সম্ভব হবে না। আমি এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।”
গত ৬ নভেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ লেখেছেন, “কক্সবাজার জেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেহাল দশা। এক রাতে মহেশখালীর কেএম ছড়ায় নিহত এক ও লিংক রোডে গুলিবিদ্ধ ২ ভাই। পুলিশের উপস্থিতিতে গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে।”
সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম কর্মী এইচএম নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি জানি. একদিন ঠিকই আমাকেও প্লেন করে মেরে দিবে ওরা! তারপর, যথারীতি ওরা বাজাবে সেই পুরোনো রেকর্ড .. মিথ্যা, পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্রমূলক। মনে রাখবেন, মূলত এই তিনটি শব্দ ই হচ্ছে ঘাতক কিংবা আততায়ী। ”
এছাড়া কক্সবাজারের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার আরো অনেকে কক্সবাজারের আইন-শৃংখলার অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে নিজেদের অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এতে তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারে চুরি, ছিনতাই, দখল-বেদখল, মাদকপাচার, অপহরণ ও খুনের মত অপরাধকর্ম বেড়েই চলছে। গত কয়েক মাসে আলোচিত বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড ও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে জেলার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এতে সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন্ শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোও।
আইন-শৃংখলার অবনতিকর এ পরিস্থিতির জন্য সচেতন মহল পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বাহিনীগুলোর অকার্যকর ভূমিকাকে দায়ী করেছেন।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply